শ্রেয়া আর রিতমের জীবনের গল্পটা খুব সাধারণ হলেও, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এক গভীর বাস্তবতা। তিন বছর আগে, একে অপরের ভালোবাসায় আবদ্ধ হয়ে শুরু হয়েছিল তাদের বিবাহিত জীবন। প্রথম প্রথম সবকিছুই স্বপ্নের মতো ছিল। নতুন জীবন, নতুন আশা, আর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক পরিকল্পনা। কিন্তু সেই স্বপ্নের সংসার আজ ভেঙে যাওয়ার পথে। আদালতের কক্ষে দাঁড়িয়ে দু’জনেরই চোখে জল, কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। আজ তাদের ডিভোর্স হবে।


কেন এই ডিভোর্স? কারণটা  জটিল নয়, কিন্তু গভীর। তাদের মধ্যে ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না। তারা একে অপরকে ভালোবাসত, এখনও বাসে। কিন্তু ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও, তারা কখনও নিজেদের মনের কথাগুলো মুখ ফুটে বলতে পারেনি। অভিমান, ইগো আর ভুল বোঝাবুঝি তাদের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।


রিতম একটা  নামকরা কোম্পানিতে চাকরি করে। তার কাজের চাপ এতটাই বেশি যে, সংসার আর শ্রেয়ার জন্য সময় বের করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন রিতমের ব্যস্ততা তাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাঁকা জায়গা তৈরি করে। অন্যদিকে, শ্রেয়া ছোট থেকেই তার মা-বাবার খুব কাছের। বিয়ের পরও সে প্রায়ই শশুরবাড়ি ছেড়ে তার মা-বাবার কাছে চলে যেত। রিতম চাইলেও কখনও তাকে সঠিকভাবে বোঝাতে পারেনি যে, এই অভ্যাসটা তাদের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।


তাদের মধ্যে প্রায়ই ছোটখাটো বিষয়ে ঝগড়া হতো। ঝগড়ার কারণ কখনও সময় দেওয়া, কখনও শ্রেয়ার পরিবারের প্রতি বেশি মনোযোগ। কিন্তু এই ঝগড়াগুলো কখনও গভীর আলোচনায় পৌঁছায়নি। তারা একে অপরকে অভিযোগ করে চুপ করে যেত। এই চুপ করে থাকার অভ্যাসই আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্কের ভিত নড়বড়ে করে দেয়।


তিন বছরের এই সংসারে অনেক সুখস্মৃতি জমে আছে। প্রথম বিয়ের দিন, একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, রাত জেগে সিনেমা দেখা, কিংবা শ্রেয়ার জন্য রিতমের চমক দেওয়া। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো তাদের একসঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু আজ, সেই মুহূর্তগুলোও অভিমানের ভারে চাপা পড়ে গেছে।


ডিভোর্সের দিন সকালে শ্রেয়া রিতমকে একটা চিঠি দিয়েছিল। সেখানে লেখা ছিল, “তোমার জন্য সময় পাইনি বলে অভিযোগ করেছিলাম, কিন্তু বুঝিনি, তোমার কষ্টার্জিত সময়েই আমার স্বপ্নগুলো পূর্ণ হতো। অভিমানটা বেশি ছিল বলে ভালোবাসাটা বুঝতে দেইনি। আজও তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু সেটা বলার সময় হয়তো পেরিয়ে গেছে।”


রিতমও চিঠির উত্তর দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ভেতরের ইগো আর লজ্জা তাকে বাধা দেয়। তার মনের ভেতরেও একই কথা বাজছিল— “ভালোবাসতাম, আজও ভালোবাসি। কিন্তু তোমাকে বুঝতে পারিনি, আর সময় দিতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল সব ঠিক করার, কিন্তু কখন যেন দেরি হয়ে গেছে।”


আদালতে তাদের ডিভোর্স কার্যকর হলো। দুই জনেই একে অপরের দিকে শেষবারের মতো তাকালো। চোখে জল, কিন্তু মুখে একটাও কথা নেই। ( আরাধ্যা রায়)  


এই গল্পটা শুধু শ্রেয়া আর রিতমের নয়। এই গল্পটা আজকের যুগের অনেক সম্পর্কের প্রতিচ্ছবি। ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও, অভিমান আর ইগোর কারণে সম্পর্কগুলো ভেঙে যায়। সময়মতো মনের কথাগুলো না বলা, একে অপরের চাওয়া-পাওয়া না বোঝা, আর ছোটখাটো ভুলগুলো শুধরে না নেওয়া—এসবই ভালোবাসার সম্পর্ককে ধ্বংস করে দেয়।


শ্রেয়া আর রিতমের গল্প তাই শুধুই একটা বিচ্ছেদের গল্প নয়। এটা একটা শিক্ষা। সময় থাকতে নিজের ভালোবাসাকে বোঝানো, মনের কথাগুলো প্রকাশ করা, আর অভিমান ভুলে একসঙ্গে থাকার চেষ্টা করাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।